ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়

কোন ব্যক্তির ব্লাড প্রেশারের রিডিং যখন ১৪০ / ৯০ বা তারো বেশি হয় তখন আমরা নিশ্চিত হই যে,উনার হাই ব্লাড প্রেশারের সমস্যা আছে। যদিও  বয়স এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে ব্লাড প্রেশারের রিডিং কম বেশি হতে পারে।   মেডিকেল বিজ্ঞানে ইতোমধ্যেই হাই ব্লাড প্রেশারকে নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি বেড়ে গেলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার বলা হয়। ব্লাড প্রেশার সাধারণ দুই ধরনের তথা সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক।

পরিবারে বাবা মার উচ্চ রক্তচাপ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেরও উচ্চ রক্তচাপ হতে  পারে। আগে ধারণা করা হতো,শুধু মাত্র বয়স্কদের ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। কিন্তু এখন গবেষণায় প্রমাণিত যেকোনো বয়সী মানুষেরই উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।  তবে নারীদের তুলনায় পুরুষের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি। ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়

সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের ভিত্তিতে আমরা ধারণা করতে পারি কেউ উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত কি না।

উচ্চ রক্তচাপ-এর কিছু প্রাথমিক লক্ষণঃ

  • মাথা ঘোরানো বা মাথা হালকা অনুভূত হওয়া।
  • মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
  • বসা বা শোয়া থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘোরা অর্থাৎ ভারসাম্যহীনতা।
  • চোখে অন্ধকার দেখা।
  •  ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া।হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা,
  •  খুব বেশি তৃষ্ণা অনুভূত হওয়া।
  • অস্বাভাবিক  হৃদকম্পন।
  • নার্ভ বা পালসের গতি বেড়ে যাওয়া।

উচ্চ রক্তচাপের ক্ষতিকর দিক সমূহঃ

উচ্চ রক্তচাপ থেকে প্রাণঘাতি নানান রোগের সৃষ্টি হয়,এই কারণে ডাক্তাররা অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপকে নানাবিধ রোগের জনক বলে অবিহিত করেন।

উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্টে রক্ত চলন হ্রাস পেয়ে ইস্কেমিয়ার সৃষ্টি করে। উচ্চ রক্তচাপের ফলে হার্ট অ্যাটাকের মতোও ঘটনা ঘটতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধানতম কারণ। অতিরিক্ত রক্তচাপ চোখের নালীর ক্ষতি করে এমনকি অকালে মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে। হাই ব্লাড প্রেশার কিডনির ও বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করে থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের উপায়ঃ

উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে বেশি  ঝুঁকিতে থাকেন  অতিরিক্ত মেদ যুক্ত  স্থুল মানুষেরা। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধের  প্রাথমিক বিষয়টি হলো শরীরের অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ করা অর্থাৎ ওজন কমানো। সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে মাত্রাতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ না করা।কারণ মেদহীন মানুষেরা অনেকটাই নিরাপদ উচ্চ রক্তচাপ থেকে।

  • অলস জীবন পরিত্যাগ করুন

দৈনন্দিন জীবনের কায়িকশ্রম জনিত কাজ গুলো নিজ হাতেই করার অভ্যাস করতে হবে।  মুক্ত পরিবেশে অন্তত আধা ঘণ্টায় হাঁটা বা হালকা রানিং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কোন ধরনের কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত না তাদের পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ  গুণ বেশি ঝুঁকি  থাকে উচ্চ রক্তচাপের।

  • অতিরিক্ত লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন

আগে ধারণা করা হতো,শুধু মাত্র কাঁচা লবণ উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী কিন্তু এখন গবেষণায় দেখা যায় সবধরনের লবণ এই উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। লবণের মধ্যে থাকা সোডিয়াম রক্তের গতিকে বৃদ্ধি করে এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে থাকে।  সাধারণ বলা হয়ে থাকে একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক পৌঁনে এক চা চামচ পরিমান লবণ খেতে পারবে। অতিরিক্ত লবণ শরীরের পানি ধরে রাখে যার ফলস্বরূপ উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়।

  • ধুমপান ত্যাগ করুন

বিড়ি সিগারেট  উচ্চ রক্তচাপের উল্লেখযোগ্য  আরেকটি কারণ। এগুলোতে থাকা নিকোটিন রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া নিকোটিন রক্ত চলাচলের ধমনীকে সংকুচিত করে রক্ত চলাচলে বাঁধা প্রদান করে। এতে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের মেড ক্লিনিকের জরিপের ফলাফল দেখে বলা যায়,ধূমপায়ীদের প্রেশার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীর তুলনায় আট থেকে দশ গুণ বেশি।  বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ ধূমপায়ী। সুতরাং এই পরিসংখ্যানটি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ জনক। অ্যালকোহলের মতো নেশা জাতীয় দ্রব্যও উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। যারা ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত তাদের চা, কফি,কোমল পানীয় ও  পরিহার করা উচিত। কফিতে ক্যাফেইন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা সরাসরি রক্ত চাপের জন্য দায়ী।

  • দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা

উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির উচিত নিজেকে সব সময় চাপ মুক্ত রাখা। মানসিক চাপ হাই প্রেশারের রোগীর জন্য ক্ষতিকর। নিজেকে মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে হালকা ব্যায়াম এবং মেডিটেশন করা ফলপ্রসূ । পরিবারের সদস্যদের সাথে আনন্দঘন সময় কাটালে চাপ মুক্ত থাকা যায়, তার ধারাবাহিকতায় উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকেও যথেষ্ট নিরাপদে থাকা যায়।

উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্য যে সকল খাবার উপযোগীঃ

  • শাক সবজি এবং সালাদ জাতীয় ফল  বেশি করে খেতে হবে। ছোট মাছ খেয়ে আমিষের চাহিদা পূরণ করতে হবে। গরু এবং ছাগলের মাংসে প্রচুর চর্বি থাকায় এগুলো  খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে। পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। যেমন কলা,চিনা বাদম,কাঠ বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
  • প্রতিদিন নিয়ম করে একটি বা দুইটি পাকা কলা,এক ছটাক চিনাবাদাম,দুই তিন বার শাক পাতা খাওয়া যেতে পারে,যা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমিয়ে থাকে।
  • সুগার ও ফ্যাট জাতীয় খাবার কম কম খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।  সর্বোপরি প্রত্যাহিক খাদ্যাভ্যাসের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন জরুরি।

ঘরোয়া পদ্ধতিতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ

  • পটাশিয়াম জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে পারলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ডাবের পানি, কলা, টমেটোসহ কিছু সবজিতে পটাশিয়াম রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বাদাম, শালগম, তিসি, ডার্ক চকলেট ও কালিজিরা ভালো কাজ করে।
  • রসুন উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ৷ সকালে খালি পেটে রসুন চিবিয়ে জল খেলে রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে৷
  • পিঁয়াজ জীবাণুনাশক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব কম নয়৷ পিঁয়াজ বাটা ও মধু সমানুপাতে মিশিয়ে প্রতিদিন দু’ চা চামচ পরিমান করে খেলে সহজেই উচ্চ রক্তচাপ কমানো যায়৷
  • নিমের দুটি পাতা ও তুলসি দুটো পাতা বেটে, তার সঙ্গে অল্প জল মিশিয়ে প্রতিদিন খেলে রক্তচাপ কমে৷ খালি পেটে কয়েক সপ্তাহ খেলেই এর উপকারীতা বোঝা যায়।
  • শখ করেই অনেকে ডাবের জল খেয়ে থাকেন৷ তবে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, রক্তচাপ কমানোতেও নিয়মিত ডাবের জল খাওয়া খুব জরুরি।
  • এছাড়া পোস্ত বাটাও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে৷ তাছাড়া টক দই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

 

পরিশেষে, লাইফস্টাইল পাল্টানোই রক্তচাপ কমানোর একমাত্র উপায়৷ ঠিক যে যে কারণে রক্তচাপ দেখা যায় সেগুলো বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়৷ তবে উপরের পদ্ধতিগুলি রক্তচাপ কমাতে অনেকটাই সাহায্য করে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top